ক্রিয়েটিনিন কী? ক্রিয়েটিনিন কমানোর উপায়

ক্রিয়েটিনিন কিডনির সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত একটি উৎপাদ যার দেহে মাত্রার উপর নির্ভর করে কিডনি ভালো আছে না খারাপ আছে। অতএব ক্রিয়েটিনিন সম্পর্কে আমাদের ভালো জ্ঞান থাকা জরুরী। আসলে ক্রিয়েটিনিন কী? ক্রিয়েটিনিন কমানোর উপায়, ক্রিয়েটিনিন কত হলে ডায়ালাইসিস করতে হয়? ক্রিয়েটিনিন কিভাবে পরিমাপ করা হয়? ক্রিয়েটিনিন কমানোর ঔষধ , ক্রিয়েটিনিন কমানোর প্রাকৃতিক উপায় এবং ক্রিয়েটিনিন  সম্পর্কিত তথ্যবহুল আলোচনা করবো। এই বিষয়ে জানতে আগ্রহী দের জন্য খুব উপকারী একটি ব্লগ পোস্ট হতে যাচ্ছে।

ক্রিয়েটিনিন কি?

আমাদের দেহে মাংসপেশির ফসফেট ভেঙে এক প্রকারের উৎপাদ তৈরী হয় যা ক্রিয়েটিনিন নাম পরিচিত। আমাদের শরীরে এটি সব জায়গাই নির্দিষ্ট পরিমাণে তৈরী হতে থাকে এবং ক্রিয়েটিনিন এর উৎপাদন দেহের মাংসপেশির ঘনত্বের উপর নির্ভর করে। দেহে ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে কিডনি ঠিকমত কাজ করছে না হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। অতএব আমাদের ক্রিয়েটিনিন সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখতে হবে।

ক্রিয়েটিনিন কত হলে ডায়ালাইসিস করতে হয়?

ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণের উপর ডায়ালাইসিস করা বা না করা নির্ভর করে না। এটি মুলত কিডনির কার্যক্ষমতার উপর নির্ভর করে। সাধারণত কিডনির কার্যক্ষমতা ১৫% নিচে নেমে আসলে ডায়ালাইসিস করানো উচিত। আবার ক্রিয়েটিনিনের মাত্রার উপর কিডনির অবস্থা নির্ভর করে। পুরুষদের ক্ষেত্রে ০.৬-১.২ মিলিগ্রাম/ডিএল এবং নারীদের ক্ষেত্রে ০.৫-১.১ মিলিগ্রাম/ডিএল এর বেশি ক্রিয়েটিনিন থাকলে কিডনির কার্যকারিতা ক্ষয় হতে থাকবে।

ক্রিয়েটিনিন কমানোর উপায় (1)
ক্রিয়েটিনিন কমানোর উপায়

ক্রিয়েটিনিন কমানোর ঔষধ

ক্রিয়েটিনিন কমানোর জন্য অনেক ধরনের ঔষধ বাজারে পাওয়া যায়। তবে বিভিন্ন কারন থাকার ফলে প্রয়োজন অনুযায়ী ঔষধ খেতে হবে। যেমন কিডনিতে সোডিয়ামের কমতি থাকলে Sodisalt Tablet খেতে পারেন। ইউরিক এসিড প্রয়োজনের তুলনায় বেশি থাকলে Febus 40 খেতে পারেন। এছাড়া প্রসাবের পরিমাণ কম হলে অথবা প্রসাব আটকে গেলে Frulac 20mg ট্যাবলেট খেতে পারেন। কিডনির ইনফেকশনের প্রভাবে ক্রিয়েটিনিন বৃদ্ধি পেলে Ceftriaxone 1gm ইনজেকশন দেহে পুশ করতে পারেন। এছাড়া আপনার নিকটস্থ কিডনি স্পেশালিস্টের থেকে প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ঔষুধ সেবন করতে পারেন।

ক্রিয়েটিনিন কমানোর হোমিও ঔষধ

এলাপ্যাথিক ঔষধের পাশাপাশি কিছু হোমিওপ্যাথিক ঔষধ আছে যেগুলো সেবন করলে ক্রিয়েটিনিন সহ কিডনির বিভিন্ন সমস্যা দুর করা যায়। যেমন কুপ্রাম আর্সেনিককিম ঔষধটি ক্রিয়েটিনিন সহ কিডনির বিভিন্ন সমস্যা দূরীকরণে সাহায্য করে। এছাড়া রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা প্রচুর বৃদ্ধি পেলে আরালিয়া হাইস্পিডা, সিরিআম অ্যাঙ্গুইল, আর্সেনিকাম অ্যালবাম ইত্যাদি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ সেবন করতে পারেন। তবে একজন ভালো হোমিও প্যাথিক ডাক্তারের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে ঔষধ সেবন করার চেষ্টা করবেন।

কিভাবে ক্রিয়েটিনিন পরিমাপ করা হয়?

ক্রিয়েটিনিন মুলত দুইভাবে পরিমাপ করা যায়। প্রথমত রক্ত পরিক্ষা করার মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত মুত্র পরিক্ষার মাধ্যমে। তবে বেশিরভাগ সময়ে রক্ত পরিক্ষার মাধ্যমে ক্রিয়েটিনিন টেস্ট করা হয়। আর রক্ত পরিক্ষার মাধ্যমে করলে সবথেকে নির্ভুল ফলাফল পাওয়া যায়। ক্রিয়েটিনিন সাধারণত ল্যাবে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক দ্রবাদি দিয়ে পরিক্ষা করা হয় তাই আপনি এটি বাড়িতে পরিক্ষা করতে পারবেন না।

ক্রিয়েটিনিন পরিমাপের একক কি?

ক্রিয়েটিনিন পরিমাপের সর্বজনীন একক মুলত mg/dL। এখানে mg অর্থ মিলিগ্রাম এবং dL অর্থ ডেসিলিটার। অতএব ১ mg/dL অর্থ প্রতি ১ ডেসিলিটার রক্তে ১ মিলিগ্রাম রক্ত থাকা। তবে ইউরোপ সহ কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে μmol/L এককটিও ব্যবহার করা হয়। উল্লেখ্য যে ১ mg/dL প্রায় ৮৮.৪ μmol/L এর সমপরিমাণ।

বাড়িতে কিভাবে ক্রিয়েটিনিন টেস্ট করা যায়?

ক্রিয়েটিনিন টেস্ট অনেক জটিল একটি প্রক্রিয়া। এটি মুলত ল্যাবে টেস্ট করা হয়। এছাড়া ক্রিয়েটিনিন টেস্ট করার জন্য বিভিন্ন ধরনের জটিল রাসায়নিক দ্রব্য ও যন্ত্র লাগে যেগুলো সহজলভ্য না। তাই আপনি বাড়িতে ক্রিয়েটিনিন টেস্ট করতে পারবেন না। তবে বর্তমানে অনেক টেলিমেডিসিন সেবা আছে যেখানে আপনার রক্তের নমুনা পাঠাতে পারেন। এরপর তারা আপনার রক্ত পরিক্ষা করার মাধ্যমে রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বলে দিবে।

ক্রিয়েটিনিন লেভেল কত

ক্রিয়েটিনিন লেভেল বয়স ভেদে বিভিন্ন মানের হয়ে থাকে। একজন স্বাভাবিক নারি ও পুরুষের যথাক্রমে ০.৫-১.১ মিলিগ্রাম/ডিএল ও ০.৬/১.২ মিলিগ্রাম/ডিএল হয়ে থাকে। এছাড়া শিশুদের ক্ষেত্রে ০.৩/০.৭ মিলিগ্রাম/ডিএল ক্রিয়েটিনিন থাকে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ৫.০ মিলিগ্রাম/ডিএল ক্রিয়েটিনিন থাকলে তার কিডনি বিকল হয়ে গেছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

ক্রিয়েটিনিন কমানোর খাবার

ক্রিয়েটিনিন কমানোর জন্য প্রয়োজন পটাশিয়াম। তাই আপনি পটাশিয়াম জাতীয় খাবার খেতে পারেন। আপেল, পেয়ারা, পেপে, নাসপাতি ইত্যাদি ফলমূল সাধারণত খাওয়ার জন্য ডাক্তাররা সাজেস্ট করেন। এছাড়া সোডিয়ামও নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আপনি সোডিয়াম যুক্ত ২-৫ গ্রাম অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী লবণ সেবন করতে পারেন।

ক্রিয়েটিনিন বৃদ্ধি পেলে যে খাবার গুলো খাবেন না

কিছু খাবার আছে যেগুলো ক্রিয়েটিনিন বাড়াতে সাহায্য করে। এমন খাবার আপনাকে অবশ্যই পরিহার করতে হবে। প্রোটিন জাতীয় খাবার গুলো ক্রিয়েটিনিন বৃদ্ধিতে মুখ্য ভুমিকা পালন করে। অতএব এগুলো যত সম্ভব এড়িয়ে চলবেন। এছাড়া ঠান্ডা খাবার, চর্বিজাতীয় খাবার, অত্যধিক ক্যালর যুক্ত খাবার, প্যাকেটজাত খাবার এগুলো সম্পূর্ণরুপে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবেন। এক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারেন।

ক্রিয়েটিনিন কেন বাড়ে?

এই প্রশ্নের উত্তর থেকেই আপনি বুঝতে পারবেন কেন ক্রিয়েটিনিন পরিমাপ করার মাধ্যমে কিডনির সুস্থতা নির্ধারণ করা হয়। কিডনিতে কোন সমস্যা হলে অথবা কিডনির নেফ্রন রক্ত ফিল্টারিং এ ব্যর্থ হলে রক্তে থাকা ক্রিয়েটিনিন দেহে আবার ফিরে যায়। ফলে দেহে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যায়। তাই ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ বের করে কিডনির সুস্থতা নির্ধারণ করা যায়।

ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ

রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যাওয়া মানে কিডনিতে কোন সমস্যা হয়েছে। অতএব কিডনিতে কোন সমস্যা হলে যে লক্ষণ গুলো দেখা যায় তাই ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ। এক্ষেত্রে প্রসাব কম হওয়া সহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা, বমি বমি ভাব হওয়া, ক্লান্তিবোধ করা, মানসিক পরিবর্তন ইত্যাদি ধরনের লক্ষণ দেখা দেই। এছাড়া কিডনির সমস্যা জনিত আরোও অনেক লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

  • প্রসাব কম হওয়া
  • ক্লান্তিবোধ করা
  • বমি বমি ভাব হওয়া
  • মানসিক পরিবর্তন

ক্রিয়েটিনিন কমানোর প্রাকৃতিক উপায়

কিছু প্রাকৃতিক উপায় অবলম্বন করে আপনি রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা কমাতে পটাশিয়াম অনেক সাহায্য করে। এক্ষেত্রে পেপে, পেয়ারা, আপেল, নাসপাতি ইত্যাদি ধরনের পটাশিয়াম যুক্ত খাবার খেতে পারেন। এছাড়া সোডিয়াম বৃদ্ধি করার জন্য লবণ সহ সোডিয়াম যুক্ত খাবার খেতে পারেন। তবে শিম, বরবটি, ডাল, কলিজা, মাংস ইত্যাদি খাবার পরিহার করার চেষ্টা করবেন।

ক্রিয়েটিনিন কমানোর ব্যায়াম

ক্রিয়েটিনিন কমানোর একমাত্র ব্যায়াম ডায়েট করা। এক্ষেত্রে আপনাকে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। শিম, বরবটি, ডাল, মাছ, মাংশ ইত্যাদি প্রোটিন জাতীয় খাবার সম্পূর্ন রূপে পরিহার করতে হবে। পটাশিয়াম এবং সোডিয়াম যুক্ত সুষম খাবার প্রতিদিন গ্রহণ করবেন। শারীরিক পরিশ্রমী ব্যায়াম করবেন না। করলে ক্লান্তিতে ভুগতে পারেন। তবে যোগ ব্যায়াম করতে পারেন।

শেষ কথা ক্রিয়েটিনিন কমানোর উপায় নিয়ে

কিডনি মানবদেহের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এই অঙ্গের সাহায্যেই আমাদের দেহের ক্ষতিকর সকল রাসায়নিক এবং বর্জ্য পদার্থ বাইরে বেরিয়ে আসে। তাই এই অঙ্গটিকে রক্ষা করা আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ক্রিয়েটিনিন এমন একটি উৎপাদ যা কিডনির সুস্থতা নির্দেশ করে। 

অতএব কিডনিকে ভালো রাখার জন্য আমাদের ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা কিভাবে ঠিক রাখা যায় এই বিষয়ে আমাদের জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আজকের পোস্টে আমরা ক্রিয়েটনিন বিষয়ক প্রায় সবকিছু আলোচনা করেছি। 

আজকের পোস্টটি আপনি সম্পূর্ণ পড়লে ক্রিয়েটিনিন নিয়ে সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। অতএব পরবর্তীতে কাজে লাগানোর জন্য বুকমার্কে সেভ করে রাখতে পারেন এবং এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করতে পারেন। এছাড়া দৈনিক এমন আর্টিকেল পেতে আমাদের ব্লগ প্রতিনিয়ত ভিজিট করুন। ধন্যবাদ !

1 thought on “ক্রিয়েটিনিন কী? ক্রিয়েটিনিন কমানোর উপায়”

  1. Pingback: ফরম নাম্বর দিয়ে আইডি কার্ড বের করার নিয়ম ২০২৩ -

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top